Home ভ্রমণ গল্প এক্সট্রিম বাইক প্যাকিং ট্যুর চর কুকরি মুকরি

এক্সট্রিম বাইক প্যাকিং ট্যুর চর কুকরি মুকরি

0
এক্সট্রিম বাইক প্যাকিং ট্যুর চর কুকরি মুকরি

ইডিসির এর মিটিং এ সিদ্ধান্ত হলো আমরা এইবার প্রথমবারের মত বাইক প্যাকিং ক্যাম্পিং করবো।স্থান নির্ধারণ করা হলো ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার চর কুকরি মুকরি। আমিতো এক পায়ে খাড়া যাবোই যাবো।এমনিতে এই মাস সব ছেড়ে ঘুরার উপড় আছি ,তার উপড় ক্যাম্পিং, তার উপর বিশেষ কিছু ভালোলাগার মানুষ যাবে তাও এই ট্যুরটা হবে সাইকেলে, আমি কেমনে না যাই।আমাদের প্লান হয়েছিলো আমরা ভোলা লঞ্চে যাবো বাকী পথ সাইকেলে। আমি নিজে যেয়েই বরং লঞ্চের টিকেট কাটলাম কর্ণফুলী- ৩ এ। আমরা মোট ১০ জন তাই, তিনটা ডাবল কেবিন নিলাম এবং ৪ টা ডেকের টিকেট নিলাম।

১৮ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫ টায় জগন্নাথ বিশ্যবিদ্যালয়ের সামনে সবাই একত্রিত হবার কথা থাকলেও অনেকের দেরির কারনে প্রায় ৬টা বেজে গেলো। আমাদের লঞ্চ ছাড়ার সময় ৭.১০ এ। আমাদের একটু আগে উঠতে হবে কারন আমরা সাইকেলে উঠাবো কেবিনের পাশে দু-তলায়।আমরা ৬.৩০ এর মধ্যে লঞ্চে উঠে পড়লাম এবং সাইকেল গুলা উপড়ে কেবিনের পাশে রেখে তালা মারলাম। সময়মত লঞ্চ ছাড়লেও আমরা আশাহত হলাম পৌঁছানোর কথা চিন্তা করে। লঞ্চের একটা ইঞ্জিন ছিলো নষ্ট, মুন্ডু ওপেন করে দেখলাম এর স্পীড ১০-১৩ কিমি প্রতি ঘন্টায়। এইটা ছাড়া ওইদিন আরেকটা লঞ্চ ছিলো যেটা এটার চেয়ে ছোট হবার কারনে এটাই সিলেক্ট করলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুলই করলাম।

যাইহোক আল্লাহর নামে শুরু করলাম যাত্রা। সবাই ফ্রেশ হয়ে লঞ্চের ছাদে উঠে কিছুক্ষন ফুডু তুললাম। তারপর সবাই মিলে বেশ একটা আড্ডা হলো ছাদে। ৯ টার দিকে সবাই রাতের খাবার খেয়ে নিলাম লঞ্ছে।মোটামুটি মানের একটা বাঁশ খাইলাম বলা চলে,বেটা আমাদের কাছে ১০ জনের পরিমান ডাল বিক্রি করছে ৩৫০ টাকায় অথচ তাও আমাদের চাহিদা মিটলোনা। যাইহোক সে কথা ভুলে যাওয়াই ভালো মনে হলে কষ্ট লাগে যে। খেয়ে দেয়ে সবাই প্রায় রাত ৩ টা পর্যন্ত বেশ জমিয়ে আড্ডা দিলাম।তারপর সবারই মোটামুটি ঘুম পেয়ে বসলো তাই ঘুমিয়ে গেলাম। রাতে বেশ ঝড়ো বাতাস বইছিল, সেদিন অবশ্য অনেক জায়গায় ঝড়ও হইছে। আল্লাহর রহমতে আমাদের কিছু হয়নি। যাইহোক কচ্ছপ গতি নিয়ে আমাদের লঞ্চটি প্রায় ১০ টার দিকে আমাদের গন্তব্যে এসে নামালো ঘোশেরহাট।

লঞ্চঘাট থেকে আমরা রওয়ানা দিলাম চরকচ্ছপিয়া। এখান থেকে প্রায় ৩২+ কিমি।এই পথটুকু আমরা সাইকেলে যাবো।সবাই একসাথে রওয়ানা হলাম।মাঝে দুলিয়া বাজারে থামলাম। সকালের নাস্তা করলাম আর কিছু শুকনা খাবার বিস্কুট,নুডুস ও প্রোয়জনীয় জিনিসপত্র কিনে নিলাম।কারন আমরা যেখানে থাকবো তার আসে পাশে ৩-৪ কিমি এর ভিতরে কোন মানুষ বা বাজার ঘাট নাই। আমি আর সায়েম বড় দুই প্যাক বিস্কুট,৪+৪=৮ প্যাক মিনি নুডুলস এর প্যাক, টিস্যু, ২+২=৪ লিটার পানি নিয়ে নিলাম সাইকেলের সামনে বেধে।বাজারে যতক্ষন নাস্তা সারলাম নিজেদের মানুষ মনে হয়নি।আমরা যেনো ভিন গ্রহের প্রানী ভুল করে দুনিয়াতে চলে আসছি যেভাবে মানুষ আমাদের ঘিরে রেখেছিলো,নানান প্রশ্ন করছিলো।তবে এগুলা আমাদের সাইকেলিস্টদের কাছে বেশ উপভোগ্য বিশেষ করে আমার নিজের কাছে। মানুষ যখন আগ্রহ নিয়ে আমার ব্যাপারে জানতে চায় তখন ভালো না লেগে উপায় আছে?

তবে মাঝে মাঝে বেশ যন্ত্রণাও দেয়।দ্রুত নাস্তা সেরে পাশের একটা স্কুল এ যেয়ে বাচ্চাদের সাথে নিয়ে কিছু ছবি তুলে আবার শুরু করলাম চালানো। সেইরকম ভালোমানের রাস্তা পেয়ে সবাই সেইরকম টানছে। কিন্তু আমাদের সাথে দুজন নিউ রাইডারও ছিলো যাদের কারনে অনেকে জোরে চাইলেও চালাতে পারেনি কারন এটা একটা গ্রুপ ইভেন্ট।আর সবাই একসাথে থাকাটাই বড় কথা। যাইহোক আমাদের সাথে হেলাল ভাই আর তাউফিক ভাই একটু আস্তে চালাচ্ছেন ।হেলাল ভাইয়ের আবার বিশাল এক ব্যাগ যার কারনেও বেচারার বেশ কস্টই হচ্ছিলো চালাতে।সবাই চলে গেলো সামনে সবুজ ভাই,ইউসুফ ভাই এবং আমি মোটামুটি তাদের সাপোর্ট দিয়ে নিয়ে গেলাম অনেকটা পথ। প্রায় ১টার দিকে আমরা পৌঁছে গেলাম চর কচ্ছপিয়া ঘাটে।যেয়ে দেখি আমাদের আগে ফোনে ঠিক করা মাঝি আবুল ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

এখানে বলে রাখি আমাদের এই টোটাল প্লান টা সেট করা হয়েছিলো আমাদের শ্রদ্দেয় বড় ভাই ফজলে রাব্বি ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে। কারন উনি কিছুদিন আগেই এখানে ঘুরে গেলেন।উনিই আমাদের মাঝির এবং খাবারের হোটেলের সুমন ভাইয়ে নাম্বার দিয়ে উনাদের সাথে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন।ভাইকে এর জন্য ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবোনা।তবে উনার কাছে আমরা সবাই কৃতজ্ঞ। আমরা সব গুলা সাইকেল সহ আবুল মাঝির নৌকায় উঠলাম। নৌকা যেই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে আশেপাশের দৃশ্যগুলা দেখে মনটা ভরে গেলো।আমি ক্যামেরা বের করে ক্লিক মারতে লাগলাম। একটু পর আমরা চলে এলাম বড় নদীতে।

মোটামুতি ৫ কিমি এর মত চওড়া নদীটা পাড়ি দিতেই যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলো অন্য এক জগত। আমার মনে হলো যেনো আমরা সুন্দরবন চলে এসেছি। দুই দিকে ঘন গভীর বন এর মাঝে ছুটে চলছে আমাদের নিয়ে আবুল মাঝির খেয়া। চোখ জুড়ানো সেই সবুজ বন বনানির ছবিগুলা। যতো দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি।প্রায় ১ ঘন্টা ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে আমরা এসে নামলাম চর কুকরি মুকরি বাজারে। সুমন ভাইয়ের দোকান গুগল ম্যাপ এ উনার বাবার নামে এড করা আছে লোকেশনটা নিমাই হোটেল।আমাদের জন্য উনি দুপুরের খাবার দাবার আগের রেডি করে রেখেছিলেন। আমরা ফ্রেশ হয়ে টেবিলে বসে গেলাম সবারই মোটামুটী ক্ষুধা ছিলো। ভাত, সবজি আর হাঁসের মাংস উফ!! কি যে মজার রান্না সুমন ভাইয়ের।চরম মজা পাইসি খেয়ে।খাবার শেষ করে উনার সাথে বাকি দিনের খাবারের ব্যাপারে কথা বলে আমরা রওয়ানা দিলাম এবার আসল গন্তব্যে বাজার থেকে ৩ কিমি দূরে এই পথটুকু হেটে যেতে হবে।এই বাজারের পর থেকেই শুরু হলো আমাদের আসল এডভেঞ্চার এর সময়গুলা।

আমাদের গাইড হিসাবে সঙ্গী হলেন আবুল মাঝি। উনি ও বাজার থেকে ২০ টাকা ঘন্টায় একটা সাইকেল ভাড়া নিলেন আমাদের সাথে সাইকেলে যাবেন বলে। বাজার পেড়িয়ে ডান দিকে মোড় নিতেই একটা সেতু পার হয়ে শুরু হলো খালের পাশের মাটির রাস্তা। মাউন্টেন বাইকিং কারে বলে। সে লেভেলের ভাঙ্গা রোড। আমরা যে যার ক্যারিয়ারে বা সাইকেলের সামনে যা মালামাল বেধে রেখেছিলাম অনেকের ই পড়ে গেলো। মোটামুটি চালিয়ে মাটির পথ প্রায় ১ কিমি এর উপড় পার হলাম এর পর শুরু হলো ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। সুন্দরি গাছের চিকন চিকন চোখা শ্বাসমূল এর মাঝে দিয়ে যেতে হবে আমাদের। গহিন বনের এই পথটুকুও প্রায় ১ কিমি। আমরা সবাই যেমন ভয় পেলাম তেমনি মনে মনে সবাই রোমাঞ্চিত ও ছিলাম। এমন এক বনের মাঝে দিয়ে যাবো আহ!! ভাবতে এখনো গা শিউরে উঠে। প্রথম দিকের অনেকটা পথ আমাদের সাইকেল কাধের উপড় নিয়ে পাড়ি দিতে হয়েছিলো, কারন চালানোর মত অবস্থাই ছিলোনা।সবাই অনেক কষ্টে এই পথটুকু পাড়ি দিলাম। কিছুদুর যেয়ে চালানোর জন্য চিকন একটা রাস্তা পেলাম সে রাস্তায় অনেক্ষন ধীরে ধীরে প্যাডেলিং করে বনের রোমাঞ্চকর রাইড শেষ করলাম।

সে যে কি এক অভিজ্ঞতা,কি এক অনুভুতি,কি এক রোমাঞ্চ আমি সত্যি ভাষায় প্রকাশ করে বুঝাতে পারবোনা। বন পার হবার পর একটা ছোট খাল আছে সেটা পাড়ি দিতে হবে নৌকায় তার আগে হাঁটু সমান কাদা পেড়িয়ে উঠতে হলো নৌকায়। আমাদের সাইকেল গুলা আবুল ভাই উঠাতে হেল্প করলেন। আমরা নৌকা পার হয়ে ওপারে গভিরে বনের পাশ দিয়ে বালুর চরের দিকে সামনে এগিয়ে গেলাম।ওইখানে ক্যাম্প করলাম যেখানে রাব্বি ভাইরা করে গেসিলেন।কয়েকটা বড় গাছের নিচে অল্প প্রশস্ত বালুর চর তার পাশেই নদী। নদী মানে বঙ্গোবসাগর এর একদম পাশে। চোখ মেললেই সাগরের দেখা মেলে। আর চরে ঢুকার সাথে সাথেই শুনলাম শিয়ালের ডাক এবং দেখলাম ও অনেক শিয়াল।তখন প্রায় মাগরিবের সময় হয়ে গেছে।আমাদের আগুন জালাতে হবে তাবু গাড়তে হবে অনেক সময়ের দরকার।

চারিদিকে নিকষ কালো আধার,এক পাশে গহিন বন এক পাশে সাগর,তাও জোয়ারের ফলে পানি মাত্র ১৫ হাতের মত দুরে।আবার নানা অজানা পাখির ডাক,হরিনের ডাক, শিয়ালের দলের ডাক,সাগরের আছড়ে পড়া ঢেউ এর আওয়াজ।সব মিলিয়ে কিছু সময়ের জন্য জীবনটাই যেন বদলে গেলো। কি যে এক অন্যরকম পরিবেশের সৃস্টি হলো তা বলে বুঝানো সম্ভব না। যারা এমন স্বাদ নিতে চান তারা একবার হলেও জীবনে এমন পরিবেশে থাকুন অন্তত একটা রাত। আমরা তাবু লাগানোর জায়গা সিলেক্ট করে আগে জায়গাটা ভালোভাবে পরিস্কার করে ঝরা পাতা বিছিয়ে দিলাম যেন বালুর ঠান্ডা কম লাগে তারপর একে একে তিনটা তাবু সাজানো হলো।

এর মাঝে সব থেকে বড় অবদান আমাদের বস রায়হান সবুজ ভাইয়ের।সবাই তাবু সেটিং করতে পারেনা, আবার আমাদের এই টিমের মোটামুটি বেশিরভাগ লোকেরই এটাই প্রথম ক্যাম্পিং।তাই সবুজ ভাই,তুরিন ভাই,মুরছালীন ভাই এবং আমি মিলে তাবুগুলা সেট করলাম। সেট শেষ করতে দেরি ভিতরে লাইট জালিয়ে দিলাম আর DSLR বের করে শুরু করলাম ক্লিক ক্লিক ক্লিক। সেই রকম লাগছিলো ত্রিভুজ আকারে সাজিয়েছিলাম আমাদের তাবু তিনটা। কয়েকজন এই ফাকে চলে গেলো বনের ভিতর লাকরির সন্ধ্যানে।কারন শিয়ালের যে উৎপাত দেখলাম তাতে আমাদের সারারাত আগুন জালিয়ে রাখতে হবে। তাবুর পাশেই একটা মরা গাছের অবশিষ্ট ছিলো আমরা ওটাতে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলাম। দাউ দাউ করে জলছে আগুন এর মাঝেই কয়েকবার শুনলাম শিয়ালের ডাক।লাইট মেরে দেখি মামারা ধীরে ধীরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

আমরা লাইটের ব্লিংকার মারতে লাগলাম মামারা ভয় পেয়ে উল্টা চলে গেলো।একটু পর আবার আসলো আবার ব্লিংকার মারলাম আবার চলে গেলো।তখন বুঝলাম এদের জালায় রাতে আমরা নিরাপদে ঘুমাতে পারবোনা। তাই সিদ্দান্ত নিলাম ৪ জন জেগে থাকবে বাকীরা ঘুমাবে।আবার মাঝরাতে বাকীরা জাগবে এরা আবার ঘুমাবে।আমার আবার রাত জাগার অভ্যাস আছে তাই আমি,মুরছালীন ভাই,সায়েম,আলাউদ্দিন ভাই প্রথম রাত মানে রাত ৩ টা পর্যন্ত পাহাড়া দেবার দায়িত্ত নিলাম। যাইহোক রাত প্রায় ৯.৩০ এর দিকে সুমন ভাই আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসলেন সাথে আবুল ভাই ৩০ লিটারের একটা পানির ট্যাংক মাথায় করে বয়ে বাজার থেকে ৩ কিমি বনের মাঝে দিয়ে রাতের বেলা হেটে আসলেন।এখনও যে এমন সরলমনা মানুষ দুনিয়াতে আছে আসলে এই ট্যুরে না আসলে জানা হতো না। রাতের বেলায় এই গভীর জঙ্গলের মাঝে কে কার জন্য এতোটুকু করবে বলুন।উনার জায়গায় আমি হলেই কখনো করতাম না এর বিনিময়ে যত পারিশ্রমিক ই আমায় দিক না।উনাদের স্যালুট।

আমরা সবাই যে যার প্লেট নিয়ে বসে গেলাম।খাবারে ছিলো সামুদ্রিক কোরাল মাছ, সব্জি, ডাল। সবাই পেট ভরে খাবার খেলাম আর সুমন ভাই যে কতো ভালো রান্না করতে পারে যারা চর কুকরি মুকরি যাবেন একবার হলেও চেখে দেখবেন।আমাদের খাবার খাইয়ে উনি আবার এই আধারে,বনের মাঝ দিয়ে বাড়ী ফিরবেন আমিতো ভাবতেই পারছিলাম না। আবার ওইদিকে তখন জোয়ারে পানি থই থই করছে।আমাদের খাইয়ে পরে উনারা রাত ১০.৩০ এর দিকে চলে গেলেন। সবাই যে যার মত তাবুতে যেয়ে শুয়ে পড়লো জেগে রইলাম আমরা ৪ প্রহরী। আমরা আগুন জালাচ্ছি আর গল্প করছি।একটু পর এক অদ্ভুদ আওয়াজ শুনলাম বনের গভীর থেকে।আওয়াজটা কয়েকবার পেলেও কেউ বুঝতে পারছিলামনা কিসের আওয়াজ। সবাই জেগে গেলো কেউ বলে বাঘের, আওয়াজ কেউ বলে হাতির আওয়াজ।পরে সুমন ভাইকে ফোন দিয়ে শিউর হলাম এই জঙ্গলে বাঘ বা হাতী বলে কিছু নাই।তখন সবাই কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো এবং আবার সবাই শুয়ে পড়লো ।

পরে অবশ্য জেনেছিলাম এটা হরিনের ডাক ছিলো। আমরা আবার ডিউটি তে লেগে গেলাম। একটু পর তাবুর বিপরিত পাশে দেখি বেশ জোরেশোরে আওয়াজ হচ্ছে বিশেষ করে সবুজ ভাই এবং তুরিন ভাই যে তাবুতে ছিলেন সেই পাশ থেকে আওয়াজ বেশি আসছে। লাইট মেরে দেখলাম মহিশের পাল। মহিশ তার পুরা পরিবার নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে।পাশের গাছের লতা পাতা খাচ্ছে।আমরা লাইট মেরে তাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।কিছুক্ষন পর ওরা এমনিতেই চলে গেলো।এর মাঝে তিন চার বারের মত শিয়ালও তাড়ালাম । কি যে এক মধুর যন্ত্রণায় কাটাচ্ছি সময়গুলা জানি এই রকম সময় কখন আর পাবোনা।সব সৃতি হয়ে থাকবে ভাসবে চোখের কোনে।তবে আমি সেইরকম অনুভুতি পেয়েছি এই রাতে।আমার জেগে থাকা রাতগুলার মধ্যে সেরা একটা রাত। রাতের শেষ প্রহরের আগেই সায়েম ঘুমিয়ে গেলো আর শেষদিকে মুরছালিন ভাই একটু শরির লাগালো বিছানায়।

আলাউদ্দিন ভাইও গাছের গোড়ায় বসে ঝিমাচ্ছিল তাই আমিও চুপ করে বসে রইলাম মাত্র ১০ মিনিট এর মত।এর মাঝে দেখি শিয়াল পণ্ডিত পুরা দলবল নিয়া হাজির।দ্রুত সবাই উঠে লাইট মেরে তাড়ালাম তাদের।এর মাঝে আমাদের ডিউটি সময় প্রায় শেসের দিকে।এবার পালা এলো বাকীদের পাহাড়া দেবার আর আমাদের ঘুমের।সবাইকে জাগিয়ে দিয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে অনেকেই সবুজ ভাইয়ের আনা ছোট পাতিলায় নুডুলস রান্না করে খেয়ে নিলো আমি তখনও ঘুমাচ্ছি। আমার ঘুম ভাংলো প্রায় ৯ টার দিকে ।উঠে ফ্রেশ হয়ে আমিও নুডুলস রান্না করে সায়েম আর আমি খেলাম একসাথে। নদীর পাশে হাটাহাটি করে সাইকেলিং করে আবার একটু ঘুম দিতেই দুপুর হয়ে গেলো।সুমন ভাই খাবার নিয়ে হাজির।এবারের ম্যানু সব্জি,ডাল আর ইলিশ মাছ।সবাই খেয়ে নিলাম দ্রুত আর প্লান করলাম রাতে কোড়াল মাছের বার-বি-কিউ করবো আর ভুনা খিচুরি রান্না করবো নিজেরা।

সুমন ভাই সব কিছুর আয়োজন করবে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই রেস্ট নিলাম। বিকালের প্লান ছিলো বনের গভিরে ঘুরতে যাবো।তাই আমরা একটু ঘুমিয়ে নিলাম। ৪টার দিকে আমি,সবুজ ভাই,ইউসুফ ভাই,সায়েম, তৌফিক ভাই আর আলাউদ্দিন ভাই মিলে বের হলাম গহীন বনে ঘুরার জন্য,বাকীরা ঘুমাচ্ছে। প্রায় ২ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্দকর এক ট্রেইল হলো বনে গভিরে।আমরা এতো ভিতরে চলে গিয়েছিলাম যে একটা সময় আসার রাস্তাই হারিয়ে ফেলেছিলাম।ওইদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে আমরা কেউ সাথে করে লাইট নেইনি। নাম না জানা অনেক গাছ পোকা মাকড় আর মশার উপদ্রপ বনের গভীরে। পরে অনেক কষ্টে বের হবার রাস্তা খুজে পেলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে চরে।হাফ ছেড়ে বাচলাম যেন।তবে সবাই যে খুব ইনজয় করেছি এটা সবার চোখের আর মুখের ভাষায় ফুটে উঠেছিলো।

যাইহোক বন থেকে ফিরে এসে ফ্রেশ হলাম দেখি আর একটা টিম আসলো এটা ছিলো মাসুদ ভাইদের টিম।উনাদের সাথে আমাদের ফোনে যোগাযোগ হয়েছিলো।আমাদের পরিচিতদের মধ্যে ছিলেন মাসুদ ভাই,জাফর ভাই,রিফাত ভাই।উনাদের সাথে অনেক কথা হলো। আমরা সন্ধ্যায় আবার আগুন জালিয়ে দিলাম।আজ অবশ্য দিনেই অনেক লাকড়ী সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। মাসুদ ভাইরা আমাদের তাবুর একটু সামনে তাবু গাড়লো তাই আমাদের আজ রাতে গত রাতের চেয়ে একটু কম পাহাড়াতেই চলবে যেহেতু উনারাও আগুন জালিয়ে দিয়েছেন। আমরা সবাই মিলে যে যার আনা শুকনা নাস্তা খেয়ে নিলাম এবং বেশ একটা আড্ডা জমিয়ে দিলাম।সুমন ভাই আমাদের রাতের বার-বি-কিউ এর জন্য সব আয়োজন করে প্রায় ১০ টার দিকে এসে সব দিয়ে উনি চলে গেলেন।আমরা দুইটা চুলা বানালাম।একটাতে খিচুরি বসিয়ে দিলাম আরেকটা তৈরি করলাম বার-বি-কিউ এর জন্য।খুচুরি শেষে ডিম সিদ্দ করলাম আবার।

সবাই মিলে মিশে সব রান্না রেডি করলাম। বার-বি-কিউ এর জন্য কোরাল মাছ গুলা বেশ বড় সাইজেরি ছিলো। প্রায় দুই ঘন্টা পর আমাদের রান্না পর্ব শেষ হলো।আমাদের রান্নার জন্য বেশি কস্ট করলেন মুরছালীন ভাই আর সবুজ ভাই।আমরা সবাই তাদের শুধু হেল্প করলাম। এবার খাবারের পরব,যে যার প্লেটে খিচুরি নিয়ে বসে গেলাম সাথে কোরালের বার-বি-কিউ আর সিদ্দ ডিম। এমনিতে দেরি আবার সবার পেটে সেইরকম ক্ষুধা সবাই তিপ্তি নিয়ে পেট পুরে খেলাম। আমি খেয়েই বিছানায় শরির লাগাতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। রাতে অবশ্য কয়েকবার জাগতে হয়েছিলো শিয়াল তাড়াতে।এই রাতে সম্ভবত তুরিন ভাই আর আলাউদ্দিন ভাই অনেকটা রাত জেগেছিলেন। সকালে ঘুম ভাংলো ৭ টায়।সবাইকে দ্রুত রেডি হতে হবে কারন আমাদের বিকাল ৩.৩০ এর লঞ্চ ধরতে হবে। আমরা এবার আর বনের মাঝে দিয়ে সাইকেল কাধে করে যাবোনা।

যেহেতু সকালে জোয়ার আসে তাই আমরা নৌকা দিয়ে সরাসরি মাটির রাস্তার পাশে নামব সেখান থেকে সাইকেল চালিয়ে বাজারে যাবো।আবুল ভাই সকাল ৮ টার মধ্যে চলে এলেও আমাদের সব গুছগাছ করতে ৯ টার উপর বেজে গেলো। আমাদের ফিরে আসার দিনটি ছিলো ২১শে ফেব্রুয়ারী।তাই আমরা আমাদের এই বিশেষ দিনের জন্য বানানো টি-শার্ট পড়লাম।এই টি-শার্ট পড়ে সবাই বিদায় জানালাম এই মায়াভরা চরটাকে।আর হা আরেকটা কথা বলে রাখি আমরা আসার আগে যে জায়গায় ছিলাম ওটা এমন ভাবে রেখে এসেছি যে এখানে কেউ দু রাত ছিলো তার কোন চিনহ কেউ দেখাতে পারবেনা।কারন আমরা আমাদের খাবার দাবার এর খোসা গুলা পুরিয়ে ফেলেছি আর পোড়ানো সব ছাই গুলাও মাটিতে পুতে রেখে এসেছি। মনে রাখবেন আপনি যে খানেই ঘুরতে যান না কেনো চেষ্টা করবেন যেন আপনার কোন ছাপ বা শিল্পকর্ম প্রকৃতির উপড় কোন প্রভাব না ফেলে।আমরাও সেভাবেই প্রকৃতিকে যে অবস্থায় পেয়েছিলাম আসার আগে সে অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়ে এসেছিলাম।

আমরা আমাদের সাইকেল গুলা নিয়ে নৌকায় করে চলে এলাম মাটির রাস্তার পাসে।এখান থেকে চালিয়ে চলে গেলাম বাজারে।সুমন ভাইয়ের দোকানে যেয়ে রুটি,ডিম,ভাজি আর হালুয়া দিয়ে নাস্তা করলাম।উপজেলা চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করলাম ছবি উঠালাম।যাওয়ার আগে উনার সাথে ফোনে কথা হয়েছিলো কিন্তু দেখা হয়নি তাই আসার পথে দেখা করে আসলাম। বেলা ১২ টার দিকে আমরা চর কুকরি মুকরি বাজার থেকে নৌকায় চড়ে ১.৩।৩০এর দিকে আবার চর কচ্ছপিয়া ঘাটে চলে এলাম। বেলা প্রায় ৩.৩০ বেজেছিলো আমাদের সাইকেল চালিয়ে ঘোসেরহাট আসতে।তারপর ঢাকার উদ্দেশ্য লঞ্চ লালীতে করে রওয়ানা দিলাম ৪.৩০ এ। সেদিন অবশ্য আমাদের কারোই ঢাকায় ফেরা হয়নি।সে আবার এক বিশাল কাহিনি।পরে আমরা কয়েকজন বরিশালের কয়েকটা জেলাসহ মাদারীপুর, ফরিদপুর ঘুরে ঢাকায় আসলাম সাইকেলে চড়ে।

সেই লেভেলের এক এক্সট্রিম ট্যুর হলো আমার লাইফে,যে সকল অভিজ্ঞতা আর অনুভুতির সাথে পরিচয় হলো তা আর হবে কিনা জানিনা।তবে খুব ইঞ্জয়েবল একটা ট্যুর দিলাম।আর সাথে যারা ছিলেন তাদের কথা আর কি বলবো এক্টার চেয়ে একটা জোকার।সারাক্ষন হাসিতে খুশিতে মেতে ছিলাম পুরা ট্যুরে।সবুজ ভাই,ইউসুফ ভাই,মুরছালীন ভাই,তুরিন ভাই,আলাউদ্দিন ভাই,হেলাল ভাই, তৌফিক ভাই,তপু ভাই,সায়েম সবাই এতো বেশি মজা করছি যেনো আমরা সবাই এক সাথে ছোট হতে বড় হইছি।অথচ বয়সের অনেক ভেদাভেদ ও ছিলো। সবাই খুব ফ্রেশ মাইন্ডের হলে যা হয় আর কি।সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাকে এমন একটা ইঞ্জয়েওবল ট্যুর উপহার দেবার জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here